আসাদজামান
যুদ্ধ জীবনের অংশ। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান চোখে তার অজস্র স্বপ্ন। বাবা ছাপোষা স্কুল শিক্ষক । বাবা যা বেতন পায় তার সবটাই চলে যায় ছেলের লেখাপড়ার পেছনে। আশা তবু সন্তান মানুষ হোক। স্কুল কলেজ আর ভার্সিটির গোন্ডি পেরিয়ে ছেলেটি নেমে পড়ে জীবন যুদ্ধে। চাকরির প্রয়োজনে ঘুরতে থাকে বিভিন্ন অফিসে অফিসে। তখন চাকরি যেন সোনার হরিণ। তাই এক সময় সিদ্ধান্ত নেয় সরকারি চাকরির পেছনে আর নয়।
অবশেষে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিক্রয় প্রতিনিধির চাকরি নিয়ে চলে যায় মফস্বলে। গ্রামের ছেলে,মফস্বলে চাকরি করতে তাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। ছোটবলা থেকেই সে মানুষের সাথে মিশতে পারতো। সে বুঝে যায় বিক্রয় প্রতিনিধির চাকরি আসলে কিছু নয় ;মানুষের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। গ্রামের ছেলে সকালে দাঁতন করতে করতেই যেখানে শ’খানেক মানুষের সাথে আলাপ হয়ে যায়!
তার জন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি তো এক মামুলি ব্যাপার। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই সে একটা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছে। তার গাঁয়ে এমন কোন কালচারাল প্রোগ্রাম ছিলোনা যেখানে তার পরিবারের ভূমিকা নেই। সকলের সাথে মেশার সুবাদে তার পরিচিতি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, এমন কি স্হানীয় লোকজনের সাথে গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক।
সবাই তাকে অতি আপন করে নেয়, ছোট খাটো কোন সমস্যা হলে উৎসাহ নিয়ে তা সমাধানে এগিয়ে আসে সবাই। সেই সাথে বাড়তে থাকে তার চাকরি তথা ব্যবসার পরিধিও। চাকরি সংসার পিতামাতা ভাইবোন সবাই কে নিয়ে বেশ ভালোই কাটছিলো দিন।
হঠাৎ একদিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ফোন ; আপনি কোথায়?
তখন ঝুম বৃষ্টি। নেহায়েত বসের ফোন বলে ছেলেটি ফোন রিসিভ না করে পারেনি। ছেলেটা উত্তর দেয় স্যার আমিতো মার্কেটে!
বস কিছুসময় নিশ্চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে আপনি মার্কেটে! যান বাসায় গিয়ে আমাকে একটা ফোন দেন, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।
ছেলেটা তো খুউব চিন্তিত, কি এমন কথা যে উনি আমাকে বাসায় গিয়ে ফোন দিতে বললেন!
এর মধ্যে তার এক কলিগের ফোন প্রথমে সে জানতে চাইলো ছেলেটা কেমন আছে, তারপর যে কথাগুলো বললো তা শুনে ছেলেটা নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তাকে নাকি বস বলেছিল দেখেন পদোন্নতি এমনি এমনি হয়না। যে ছেলে এই ঝুম বৃষ্টিতে মার্কেটে কাজ করছে তার পদোন্নতি হবেনা তো কার হবে।
কলিগের কথা বিশ্বাস না করে ছেলেটা বাসায় এসে ভয়ে ভয়ে বস কে ফোন দেয়।
তার কিছুক্ষণ পর মাটিতে গা এলিয়ে দেয়। তার স্ত্রী জানতে চায় কি হয়েছে?
চোখ দিয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে জল।
সে জল যেন বলতে চায় অনেক কিছু। শুধু বুঝে নিতে হবে, স্পষ্ট হরফে পড়ে নিতে হবে সে ভাষা।
ছেলেটি সেই আবেগঘন মুহূর্তে তার বসকে আর কিছু বলতে পারেনি। কেবল অস্ফুট আওয়াজ, স্যার রাখি।
তারপর…….
আবার যুদ্ধ ;শুরু মফস্বল হতে জেলা শহরে। সে নিজেই এখন বস। অসংখ্য দায়িত্ব তার কাঁধে। তিনজন মাত্র কলিগ ;এরিয়া পুরো জেলা ! নূতন কে কেউ মেনে নিতে চায়না। তাইতো নানা বাধাবিপত্তি ও উপহাস মাথায় নিয়ে শুরু হয় পথচলা। আবার সেই একই কাজ ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি, ব্যবসার পরিধি বাড়ানো।
ধীরে ধীরে সে কাজেও সফল হয় সে, বাড়তে থাকে কলিগের সংখ্যা, বাড়ে ব্যবসা আবার পদন্নোতি।
একজন আদর্শ বসের যে গুণাবলি থাকার প্রয়োজন তার কোনটারই কমতি ছিলোনা তার। এ কথা লোকমুখে প্রচারিত।
লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ এক কলিগ কে নিয়ে দিনের পর দিন তাকে অসংখ্য গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। এমন কি তাকে চাকরি থেকে বাদ দেবার জন্য উপরের বহু চাপ থাকা সত্ত্বেও সে তাকে বাদ দেয়নি। তাকে সংশোধনের চেষ্টা চালিয়েছে। যার জন্য এত লাঞ্ছনা সেই কলিগ একদিন তার বসের সাথে খারাপ আচরণ করে বসে। বস তাকে বুঝিয়ে বলে। কিন্তু কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যায়না।
একদিন হঠাৎ একটা চিঠি হাতে সেই কলিগ তার বসের সামনে আসলে বস জানতে চায় তার কি হয়েছে?
কান্নাজড়িত কন্ঠে সে বলে, স্যার আমার তো আর চাকরি নেই।
চাকরি নেই!
বসের ইচ্ছে করে তার গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিতে।
বসতো কতকিছুই শেখানোর চেষ্টা করেছে। সে শুনেছে সব, সে যা ভালো বুঝেছে তার বাহিরে কিছুই করেনি।
বসের মনে তখন নানান প্রশ্ন, তবে কি বেশি সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে সে কলিগের ক্ষতি করে ফেলেছে?
চাকরি তো আর ফেরানো যাবে না। সেটা উপর মহলের সিদ্ধান্ত।
নিজেকে ব্যর্থ মনে করে বিষন্ন চোখে তাকায় বস, আর মনে মনে ভাবে মানুষকে কিভাবে ভালোবাসতে হয় তা বোধ আজও সে শিখে উঠতে পারেনি…..।